আদা চাষের আধুনিক পদ্ধতি : Ginger cultivation in modern methods:
মশলা হিসেবে আদা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। মশলা ছাড়াও আদা নানান ধরনের ওষুধ তৈরীর কাছে ব্যবহৃত হয়। আদা ভারতের সর্বত্র বিশেষ করে কেরল, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে চাষ হয়। শুকনাে আদায় শতকরা ৫০ ভাগ স্টার্চ, ১.২ ভাগ উদ্বায়ী তেল এবং বিভিন্ন পরিমাণে প্রােটিন, রেজিন ইত্যাদি উপাদান থাকে।
![]() |
আদা চাষের প্রয়োজনীয় জলবায়ু:Ginger cultivation.
আদা চাষের জন্য গরম ও সিক্ত আবহাওয়াই উপযুক্ত। অল্প-বিস্তর ছায়া আছে এমন জায়গায় আদা চাষ ভালই হয়। আদা বর্ষাকালে বৃষ্টির জলেই ভাল চাষ হয়। সমুদ্রের সমতলবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে ১৫০০ উচু পার্বত্য অঞ্চলেও এর চাষ করা যায়।
আদা চাষের উপযোগী মাটি : Ginger cultivation.
উচু বেলে দোআঁশ, দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটিতে আদা ভাল চাষ হয়। বর্ষার চাষ বলে জমিতে জল নিকাশের ভাল ব্যবস্থা থাকা দরকার। এই কারণে যে, জমিতে জল জমে থাকলে আদা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
আদা চাষের জমি তৈরীর পদ্ধতি :
আদার মাটি খুব ঝুরঝুরে করে তৈরী করা দরকার। ৭-৮ বার লাঙল ও মই দিয়ে ভালভাবে মাটি তৈরী করে নিতে হবে। এ সময়ে একর প্রতি ৮-১০ গাড়ি গােবর বা আবর্জনা সার মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।
বীজ লাগাবার পদ্ধতি:Ginger cultivation.
(১) বীজ লাগানাের সময় :- সেচের সুবিধে থাকলে বৈশাখ মাসে আদা লাগানাে যায়। কিন্তু অসেচ জমিতে জ্যৈষ্ঠ মাসে আদার বীজ বােনা উচিত, কারণ মাসখানেক পরেই বর্ষা নামে।
(২) বীজ আদা শােধন :-
৭৫-৮০ লিটার জলে ১০০ গ্রাম এমিস-৬ বা ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ডব্লিউ-পি (যেমন ডাইথেন-এম-৪৫) গুলে তাতে এক কুইন্টাল বীজ আদা এক মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর জল থেকে বীজ আদা তুলে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে বুনতে হবে। আদা বীজ লাগানাের আরাে একটি পদ্ধতি, ঝুড়িতে কিছু খড় বিছিয়ে ছােট ছােট বীজ আদা তার ওপর রেখে খড় বা থলে বন্দী করে রাখলে আদার কল’ বের হবে, আর এরকম ‘কল’ লাগা আদা লাগালে তাড়াতাড়ি গাছ গজাবে।
(৩) বীজ বােনার পদ্ধতি :- সরু লাঙল বা কোদাল দিয়ে ২০-২২ ইঞ্চি (৫০-৫৫ সেমি.) দূরে দূরে নালি কেটে তাতে ৬-৭ ইঞ্চি (১৫-১৭.৫ সেমি.) দূরে দূরে দু’তিনটি চোখ সহ আদার টুকরাে লাগাতে হবে। যে জলবায়ু বৃষ্টিপাত বেশি হয় এবং মাটি এঁটেল বা সেচ দিয়ে আদা চাষ করা হয়, সেখানে ওই একই দূরত্বে কোদাল দিয়ে ভেড়ি তৈরী করে তাতে আদা লাগানাে হয়।
(৪) বীজের পরিমাণ :- প্রতি একরে ৪-৫ কুইন্টাল বীজ আদার প্রয়ােজন। আদা অল্প ছায়া-ঘন জায়গায় ভাল ভাবে বেড়ে ওঠে বলে জমির ধারে ধারে ছায়া দেওয়া গাছ লাগিয়ে রাখতে হবে।
আদা চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি :
আদার ভাল ফলন পেতে হলে শেষ চাষের আগে প্রতি একরে ৪০ কেজি নাইট্রোজেন, ৬০ কেজি ফসফরাস এবং ৫০ কেজি পটাশিয়াম প্রয়ােগ করতে হবে। এছাড়া প্রতি একরে ২৫০ কেজি সর্ষের খােল দিলে সুফল পাওয়া যায়। আদা লাগানাের এক মাস পরে প্রতি একরে ২০ কেজি নাইট্রোজেন চাপান সার হিসেবে দিতে হবে।
অথবা
বিঘা (৩৩ শতক) প্রতি ১৫-২০ কুইন্টাল কম্পোস্ট সার
প্রয়ােগ করে ৩-৪টি চাষ দেওয়া হয়। বিঘা প্রতি ২ কেজি অ্যাজোকস প্রয়ােগ
করা যায়। রাসায়নিক সার প্রয়ােগ করা হবে বিঘা প্রতি নীচের যে কোনাে একটি
সেটের মতো।
সেট-১ : ইউরিয়া ১৮ কেজি, সি.সু.ফসফেট ৫০ কেজি, মিউ. পটাশ ৯ কেজি।
সেট- ২ : ইউরিয়া ১১ কেজি, ডিএ.পি ১৮ কেজি, মিউ, পটাশ ৯ কেজি।
সেট-৩ : ইউরিয়া ১৩.৫ কেজি, এনপিকে ২০.৫ কেজি (১০:২৬:২৬), সি.সুফসফেট ১৬.৫ কেজি।
চাপান সার : (কন্দ লাগানাের ২১ ও ৪০ দিন পর বিঘা প্রতি প্রতিবারে একই পরিমাণ সার) ইউরিয়া—৯ কেজি, মিউরেট অব পটাশ—৪.৫ কেজি।
আদা চাষে পরিচর্যা :
আদার বীজ ১৫-২০ দিনের মধ্যে গাছ বের হয়। জমিতে দু-তিনবার নিড়েন দিয়ে আগাছা তুলে ফেলতে হবে।গাছ কিছুটা বড় হলে গাছের গােড়ায় মাটি দিয়ে ভেড়ি বেঁধে দিতে হবে। এতে যে নালা তৈরী হবে তা জলসেচ ও জল নিকাশের কাজে ব্যবহৃত হবে।
আদা চাষের জলসেচ পদ্ধতি :
আগেই বলেছি, আমাদের দেশে বর্ষায় বৃষ্টির জলেই আদা চাষ হয়ে থাকে।তবে সময় মতাে বৃষ্টি না হলে বা খরা দেখা দিলে সেচ দেওয়া অবশ্যই প্রয়ােজন। ভাল ফলনের জন্য আদার জমির মাটি সরস থাকা দরকার। এর জন্য ৮-১০ দিনের ব্যবধানে সেচ দিতে হবে।
আদার বিভিন্ন প্রকার জাতঃ
আদার কয়েকটি জাত আছে। যেমন - চায়না, গরুবাথান, সুরভি, সম্বক, মরান, সুপ্রভা, রিও-ডি জেনিয়াে ইত্যাদি।
ফসল তােলার পদ্ধতি :
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বােনা আদা পৌষ মাসে তােলার উপযােগী হয়। গাছের পাতা হলদে হলে এবং ডাটা শুকোতে শুরু করলে ফসল তুলে ফেলতে হবে। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে আদা তােলা হয়। আদা তুলে মাটি পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে।
আদা সংরক্ষণ পদ্ধতি :
আদা সারা বছর ধরে পাওয়ার জন্য সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।লবণ, এসেটিক অ্যাসিড ও পটাশিয়াম মেটাবাই সালফেটের মিশ্রণে আদা ডুবিয়ে রাখলে সারা বছর গরম থাকে। সাধারণত ৫০ গ্রাম লবণ এক লিটার জলে মিশিয়ে এবং প্রক্রিয়া তৈরী করা হয়। এক কেজি আদার জন্য এই মিশ্রণ এক থেকে সওয়া এক লিটার দরকার।
সংরক্ষণের জন্য ভাল বাছাই করা পাকা আদা জলে ধুয়ে ও খােসা ছাড়িয়ে টুকরাে করে নিতে হবে। এই টুকরাে আদা বয়ানের গলা পর্যন্ত ভরে আগের মিশ্রণের পরিমাণ মতাে দিয়ে বয়ানের মুখে ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। ঢাকনা দিয়ে যাতে বাতাস ভেতরে প্রবেশ না করে তার জন্য বয়ানের মুখ মােম দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর ঠাণ্ডা ও অন্ধকার জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। এ ভাবে সংরক্ষিত আদা এক বছর ধরে ব্যবহার করা যায়।ব্যবহারের আগে আদা আর ধোয়ার প্রয়ােজন নেই।
আদা চাষে শস্য রক্ষার করনীয় পদ্ধতি :
আদার কোনাে মারাত্মক ধরনের রােগ-পােকার শত্রু নেই। তবে বর্ষা বেশি মাত্রায় হলে রাইজোম পচা রােগ দেখা দিতে পারে। জমিতে এ রােগ দেখা দিলে গুদাম ঘরে আদার পচন হতে থাকে। তাই এর প্রতিকার হিসেবে এমিসন-৬ বা বাগালাল -৫ বা ডাইথেন এম-৪৫ দ্রবণে আদা শােধন করে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে রােগের প্রকোপ কম হয়।
আদা চাষে বিভিন্ন পোকা ও রোগের সংক্রমণ থেকেআদাকে কীভাবে রক্ষা করবেন তার বিস্তারিত নিচে আলোচনা থেকে জেনে নিন।
মাজরা পােকা :
সবুজ রঙের লেদা মাটির লেভেল বরাবর কাণ্ডের মধ্যে ঢুকে শাঁস খায়। আক্রান্ত কাণ্ড পাতাসহ হলদে হয়ে যায় কিংবা শুকিয়ে যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষ করা উচিত। প্রতি লিটার জলে ১.৫ গ্রাম বি.টি. বা ১ মিলি রিজেন্ট বা ০.১ গ্রাম ড্যানটপ গুলে স্প্রে করা যায়।
শক্ত আঁশ পােকা :
কন্দের ওপর থেকে চ্যাপ্টা আঁশ পােকা রস চুষে খায়। কন্দ চুপসে যায় এবং আক্রান্ত কন্দ থেকে গজা বার হতে সমস্যা দেখা দেয়। প্রতি লিটার জলে ২ মিলি মার্শাল গুলে কন্দ গুদামজাতকরণ বা বসানাের আগে ভেজানাে হয়।
নেমাটোড :
নেমাটোডের আক্রমণে অনেক সময় গাছ চুপচাপ বসে থাকে। পাতা হলদে হতে থাকে।পাতার ধার পুড়ে যেতে শুরু করে এবং শিকড় ফুলে যায়। বিঘা প্রতি ২৫০ কেজি নিমখােল প্রয়ােগ করা যেতে পারে।
কন্দের নরম পচা :
আক্রান্ত গাছের পাতা ফ্যাকাশে হতে শুরু করে। পাতার কিনারার ধারে হলুদ হয়ে যায়। কিন্তু পাতার মধ্য শিরার দু' পাশের রঙ সবুজ থাকে। কন্দের ওপর জলে ভেজা দাগ দেখা যায় এবং ওখানে পচন শুরু হয়। গাছে নতুন কল ধরে না। গভীরভাবে লাঙল দেওয়া এবং জলনিকাশী ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতি লিটার জলে ২.৫ গ্রাম রিডােমিল গুলে ৪০ মিনিট কল শােধন করে লাগাতে হবে। আক্রান্ত কন্দ তুলে ফেলে দিতে হবে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত কন্দ পচা :
নরম পচার মতাে একই লক্ষণ। পচা কল কেটে জলে ভিজিয়ে রাখলে পাতা থেকে ব্যাকটেরিয়া বার হয়ে জল ঘােলা করে দেবে।বসানাের আগে কন্দ ০.০২ শতাংশ স্ট্রেপটোসাইক্লিন (৫ লিটার জলে ১ গ্রাম) দ্রবণে শােধন করা দরকার।
পাতায় দাগ :
পাতায় ছােট ছােট হলুদ দাগ পরে জুড়ে গিয়ে ঝলসানাের মতাে হয়ে যায়। পাতা শুকিয়ে যায়। অনেক সময় পাতা মাঝখান থেকে ভেঙে ঝুলে পড়ে। প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম ব্লাইটক্স বা ২.৫ গ্রাম ডায়থেন এম-৪৫ গুলে স্প্রে করা যায়।
ফলন : প্রতি একরে ৮০-১০০ কুইন্টাল আদা উৎপন্ন হয়। আদা শােধন করলে এবং শুকোলে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ আদা পাওয়া যায়।
If you have any doubts or questions, please let me know.... যদি আপনার কোনও সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকে তবে দয়া করে আমাকে জানান.....