লঙ্কা চাষ পদ্ধতি। Chilli Farming :
মশলা হিসেবে লঙ্কা একটি অতি প্রয়ােজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শস্য। আমাদের দেশে উৎপাদিত লঙ্কার বেশির ভাগ মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কিছু লঙ্কা আচার ও চাটনি এবং কাঁচা সবুজ লঙ্কা সজি হিসেবে খাওয়া হয়। ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই লঙ্কার চাষ হয়। যেমন - অন্ধপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে। লঙ্কার বিজ্ঞানসম্মত নাম - Capsicum annum
ভারত থেকে কিছু লঙ্কা বিদেশে রপ্তানি করা হয়, এর ফলে কিছু বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা যায়। লঙ্কার উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল ও দক্ষিণ আমেরিকার রাজ্যগুলােয়, এরকমই
জনশ্রুতি শােনা যায় আর পরবর্তীকালে পর্তুগীজরা প্রথম ভারতে লঙ্কার চাষ
করতে শুরু করেছিল।লঙ্কা চাষ করার জন্য সঠিক নিয়ম কানুন এখান থেকে জেনে নিন।
লঙ্কা চাষে প্রয়োজনীয় জলবায়ু :
গরম ও সিক্ত আবহাওয়া লঙ্কা চাষের পক্ষে উপযুক্ত, ফল পাকার সময় আবহাওয়া শুকনো হওয়া দরকার। মাটির তাপমাত্রা ৬৫°-৮৫° ফারেনহাইট (১৮.৩°-২৯.৪৭ সেলসিয়াস) থাকলে বীজের অঙ্কুরােদগম ভাল হয়। অধিক সূর্যের তেজে ফলন বেশি হলেও এর ঝাল ও রঙ কমে যায়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টি লঙ্কার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ফুল ফোটা ও ফল ধরবার সময় অতি বৃষ্টিতে অসময়ে ফুল ও ফল ঝরে যায়। ২০°-২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় লঙ্কার ফলন ভাল হয়।
মাটি তৈরীর পদ্ধতি :
প্রায় সবরকম মাটিতেই লঙ্কার চাষ করা যায়। তবে জল নিকাশের ও সেচের ব্যবস্থা থাকলে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিই লঙ্কাচাষের পক্ষে খুবই উপযােগী।চারা লাগাবার আগে জমিতে ৪-৫ বার আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে লাঙল ও মই দিয়ে ভাল করে মাটি তৈরী করে নিতে হবে। জমি তৈরী করার সময় প্রতি একরে ২০০-৩০০ মন গােবর বা কম্পােষ্ট সার প্রয়ােগ করে ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে।
বীজ বপন পদ্ধতি :
(১) বীজ বােনার সময় :- লঙ্কা প্রায় সারা বছর ধরেই চাষ করা যায়। লঙ্কা অল্প দিনের ফসল। তবে সাধারণত শীতকালীন লঙ্কার বীজ ভাদ্র- আশ্বিন মাসে, বর্ষাকালীন লঙ্কার বীজ বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং গ্রীষ্মকালীন লঙ্কার বীজ অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বীজতলায় বােনা হয়। প্রতি একরে ২৫০ গ্রাম বীজের প্রয়ােজন হয়।
(২) বীজ শােধন :- প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে তিনগ্রাম থাইবাব বা ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ডব্লিউ-পি মিশিয়ে বীজ শােধন করে নিতে হবে।
(৩) বীজ বােনার পদ্ধতিঃ- বেগুনের মতাে বীজতলায় বীজ বুনে চারা তৈরী করে নিতে হয়।
লঙ্কা চারা লাগানাের পদ্ধতি :
৭-৮ সপ্তাহের চারা লাগানাের পক্ষে উপযােগী হয়। বীজতলা থেকে সতেজ ও পুষ্ট চারা তুলে বিকেলের দিকে লাগাতে হয়। দু ফুট (৬০ সেমি.)-এর ব্যবধানের সারিতে দেড় ফুট (৪৫ সেমি.) দূরে দূরে চারা লাগাতে হবে। লাগানাের পর চারার গােড়ার মাটি অল্প চেপে দিতে হবে। কোনাে চারা মরে গেলে সেই জায়গায় নতুন চারা লাগিয়ে দিতে হবে।
লঙ্কার বিভিন্ন জাত :
লঙ্কার জাত সাধারণত দু জাতের হয়। যেমন :
(১) কম ঝাল বা ঝালবিহীন লঙ্কা :- এটা কেপসিকাম ফুটিসেল নামেই পরিচিত এবং আচার ও বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(২) ঝাল লঙ্কা :- এটির পরিচয় কেপসিকাম এনাম হিসেবে এবং মূলত মশলা হিসেবে পরিচিত। ক্যাপসাইসিন নামক রাসায়নিক পদার্থের জন্য এই জাতের লঙ্কা ঝাল হয় এবং কেপসানফিন নামক একটি রঞ্জক পদার্থের জন্য লঙ্কা উজ্জ্বল লাল হয়। লঙ্কায় ভিটামিন “এ” ও “সি” থাকে।
কাঁচালঙ্কায় শতকরা ৮২.৬ ভাগ জল ৬১ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ২.৯ ভাগ প্রােটিন, ০.৬ ভাগ ফ্যাট, ১.০ ভাগ খনিজ পদার্থ ও খাদ্যপ্রাণ “সি” থাকে।
লঙ্কা চাষে সার প্রয়ােগ পদ্ধতি :
প্রতি একর জমিতে ৪০ কেজি নাইট্রোজেন, ২০ কেজি ফসফরাস, এবং ২০ কেজি পটাশিয়াম দিতে হবে, জমি তৈরীর সময় পুরাে ফসফরাস ও পটাশিয়াম এবং অর্ধেক নাইট্রোজেন মূল সার হিসেবে দিতে হবে। চারা লাগানাের একমাস ও দুমাস পরে প্রতিবারে ১০ কেজি করে নাইট্রোজেন চাপান সার হিসেবে প্রয়ােগ করতে হবে।
লঙ্কা চাষে পরিচর্যা :
মাটি থেকে আগাছা দমন, মাটি আলগা ও ঝুরঝুরে করার জন্য মাঝে মাঝে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে দিতে হবে। চাপান সার দিয়ে গাছের গােড়ায় মাটি দিয়ে ভেড়ি বেঁধে দিতে হবে। এর ফলে যে নালা তৈরী হবে তা দিয়ে জলসেচ দেওয়া হবে। গাছ যাতে নুইয়ে না পড়ে তার জন্য গাছের গােড়ায় লাঠি পুঁতে গাছ বেঁধে দিলে কাজ হতে পারে। ৪-৫ লিটার জলে ১ মিলি সেলমােন বা প্ল্যানােফিকস গুলে গাছে ফুল ধরার সময় প্রথমবার এবং ২৫-৩০ দিন পর দ্বিতীয়বার গাছে স্প্রে করতে হবে। এতে ফুল ঝরে পড়া রােধ করা যায় এবং ফলনও ভাল হতে দেখা যায়।
লঙ্কা চাষে জলসেচ পদ্ধতি :
চারা লাগানাের পর দু-একদিন সকালে ও বিকেলে গাছের গােড়ায় সীমিত জল সেচ করতে হবে। গ্রীষ্মকালে ৪-৫ দিন এবং শীতকালে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে জলসেচ দিলেই চলবে। ফুল ফোটা ও ফল ঝরে পড়া এবং ফল বাড়ার সময় মাটিতে রস কম থাকলে অসময়ে ফুল ও ফল দুটিই ঝরে পড়ে।
পােকা ও রোগ থেকে লঙ্কা শস্য রক্ষার করণীয় উপায় :
পােকা :- লঙ্কার সঙ্গে ফল নষ্ট করার শত্রুতা এর চারা গজানাের সময় থেকে ফসল পাকার সময় পর্যন্ত। এই পােকার ধ্বংসাত্মক কাজ হলাে, কচি ও বাড়ন্ত ফল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে ফলের ভেতরের অংশ খেয়ে নেয়। এর ফলে লঙ্কার বৃদ্ধিলাভে ব্যাঘাত ঘটে এবং তার আকৃতি ভীষণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। লঙ্কার মূল গুণ অর্থাৎ তার ঝাঁঝ থাকে না, স্বভাবতই এই কারণে সেই লঙ্কার বাজারদর কমে যায়। এছাড়াও লঙ্কা গাছের আর এক শক্ত হলো চিরুনি পােকা। গাছের সব অবস্থাতেই এই পােকার আক্রমণ ঘটতে পারে। তবে এ পােকার রাগ শুধু ফুলের ওপর এবং ফুল ফোটার সময়েই বেশি ক্ষতি করে থাকে।
এই পোকার প্রিয় খাদ্য হলো পাতার রস, পাতা থেকে রস চুষে খায় সে। এর ফলে পাতা কুঁকড়ে যায়। এছাড়া এই পােকা অন্য গাছে এই একই রােগ ছড়ায়।
এদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতি লিটার জলে দেড় মিলিলিটার ফসফোসিডন ৪০ এস. এল. (যেমন সুসিডন-৪০ এসএল) বা এক মিলিলিটার মিথাইল ডেসিটন ২৫ ইসি.(যেমন মেটাসিট-২৫ ই.সি.) বা দু মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন ৫০ ই.সি. (যেমন ৫০ ই.সি.) গুলে গাছে গ্ধে করতে হবে।
রোগ :- কখনাে কখনাে লঙ্কা গাছে গােড়া পচা রােগ দেখা যায়। ৫-৭ দিনের চারাগাছ এই রােগে আক্রান্ত হয়। এর লক্ষণ হলাে রােগাক্রান্ত গাছের মাটি সংলগ্ন অংশ কালাে হয়ে যায় এবং গাছে নুইয়ে পড়ে, শেযে মরে যায়।
এ রােগের প্রতিরােধ করার ব্যবস্থা হিসেবে প্রথমেই বীজ শােধন করে বুনতে হবে, বাড়ন্ত গাছে এই রােগ দেখা দিলে প্রতি লিটার জলে দুগ্রাম করবেনডাজিম (যেমন ব্যাভিস্টিন) বা ক্যাপটান ৫০ শতাংশ ডব্লিউ-পি গুলে আক্রান্ত জমির গাছের গােড়ার মাটিতে দিতে হবে।
লঙ্কা গাছে লঙ্কা একটু বড় হলেই লাল হয়ে ঝরে পড়ে। এ রােগের নাম এনথ্রাকনােজ। আধপাকা লঙ্কার ওপরেই এ রােগের বিস্তার ঘটে। রােগাক্রান্ত লঙ্কা শুকিয়ে ও কুঁচকে যায় আর তাই অসময়ে ঝরে পড়ে।
এর প্রতিকার হিসেবে বীজ শােধন করে বুনতে হবে এবং প্রতিলিটার জলে দুগ্রাম হিসেবে কারবেনডাজিম ৫০ শতাংশে ডব্লিউ-পি গুলে (যেমন ব্যাভিস্টিন) রােগাক্রান্ত ফসলে স্প্রে করতে হবে।
এছাড়া লঙ্কাগাছে ডগা শুকা ও ধসা রােগের উপদ্রব দেখা যায়। ডগা শুকা রােগের লক্ষণ হলাে, গাছের ডগা থেকে শুকোতে শুরু করে এবং ধসা রােগে পাতা ও কাণ্ডে প্রথমে গাঢ় বাদামী দাগ পড়ে, গাছ ডগা থেকে শুকোতে থাকে।
এ রােগের প্রতিরােধ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি লিটার জলে আড়াই গ্রাম ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ডব্লিউ-পি (যেমন ডাইথেন এক-৪৫) বা জিনের (যেমন ডাইথেন জেড-৭৮) গুলে রােগক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
ফসল তােলার পদ্ধতি :
ফলন :- প্রতি একরে ২০-২৫ কুইন্টাল কাচা লঙ্কা এবং ৫-৬ কুইন্টাল শুকনাে লঙ্কা উৎপন্ন হয়। পাকা লঙ্কার ওজনের শতকরা ২৫-৩০ ভাগ শুকনাে লঙ্কা পাওয়া যায়।
আমাদের এই website-এ প্রবেশ করার জন্য আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আমরা এই ওয়েবসাইট -এর মাধ্যমে সমস্ত শাক-সবজি, ফসল চাষবাস এর সবরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পোস্ট করে থাকি। আমাদের এই পোষ্টটি ভালোলাগলে আমাদের ওয়েবসাইট (চাষবাস-বারোমাস)-টিকে Follow করতে পারেন।পারলে আপনারা LIKE ও SHARE করবেন। আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাতে পারেন আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ধ্যন্যবাদ।
_____________________________________________________________________________
If you have any doubts or questions, please let me know.... যদি আপনার কোনও সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকে তবে দয়া করে আমাকে জানান.....