Type Here to Get Search Results !

আখ (ইক্ষু) চাষের ভৌগোলিক পরিবেশ। আখের উন্নত চাষ পদ্ধতি। Sugar Cane farming.

আখ চাষের ভৌগোলিক পরিবেশ।  Sugar Cane farming:

শর্করা জাতীয় ফসল্ আখ আমাদের দেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। এই আখের ফসল থেকেই চিনি উৎপাদন হয়, আর চিনি শিল্প খুবই লাভজনক ব্যবসা, বিদেশে চিনি রপ্তানি করে আমাদের দেশ প্রচুর বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে থাকে। তাই ভারতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতিতে আখ চাষ শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। আজও আখ চাষ করে চাষী ভাইরা হাতে নগদ টাকা পেয়ে তাদের সংসারের অভাব মেটাতে পারে। বলাবাহুল্য আখ থেকে উৎপাদিত চিনি ও গুড় আমাদের নিত্য প্রয়ােজনীয় খাদ্যবস্তু। আখ চিনি উৎপাদনের প্রধানতম ফসল।তাই আখ চাষ করতে হলে তার প্রয়োজনীয় অনুকূল পরিবেশ সমূহ জানা প্রয়োজন। যেমনঃ জলবায়ু, মাটি, সার প্রয়োগ,জলসেচ ও উন্নত চাষ পদ্ধতি এবং আখের সাথে অন্য কোনো ফসল চাষ করতে পারবেন কিনা তা সমূহ বিষয় আলোচনা করলাম।


আখ (ইক্ষু) চাষের ভৌগোলিক পরিবেশ। আখের উন্নত চাষ পদ্ধতি। Sugar Cane farming.
Image by Momolebo2020 from Pixabay 

আখ চাষের  জলবায়ু :
 
আখ প্রধানত উষ্ণ ও সিক্ত অঞ্চলের ফসল। ৭০-৮০° ফারেনহাইট (২১-৬২.২° সেলসিয়াস) তাপমাত্রা আখ উৎপাদনের পক্ষে উপযুক্ত। ৭০-৭৫° ফারেনহাইট (২১-২৩° সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় বীজের অঙ্কুরােদম ভালাে হয়। ৯০° ফারেনহাইট (৩২.২° সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় আখের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। আখ পরিণত হওয়ার সময়ে হাল্কা ঝলমলে রােদ হওয়া দরকার। আখ চাষের জন্য আনুমানিক ১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত প্রয়ােজন। তবে গ্রীষ্মকালে ১০০ সেন্টি- মিটারের কম বৃষ্টি হলে জলসেচের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।

আখ চাষের মাটি  ও মাটি তৈরির পদ্ধতি :
 
মাঝারি উচু দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ মাটি সাধারণত আখ চাষের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। তবে জলসেচ এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। বালি ছাড়া সব রকমের মাটিতেই আখ চাষ করা যায়। আখ চাষ নির্ভর করে মাটিতে রস থাকার ওপর, যে মাটিতে বছরের সব সময় রস থাকে, সেই মাটিতে প্রায় সারা বছরেই আখ চাষ হতে পারে।
ভালভাবে জমি তৈরী করতে হলে সাত-আটবার লাঙ্গল দিয়ে ৬ ইঞ্চি গভীর করতে হবে। আলু চাষের জমিতে আখ চাষ করলে সে মাটির অল্প পরিচর্যা করলেই আখ চাষের উপযুক্ত করা যায়। সার বলতে একর প্রতি ৩০-৩৫ গাড়ি গােবর বা কম্পােষ্ট সার প্রয়ােগ করে মাটির সঙ্গে খুব ভালােভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। আখ গাছে উই বা কাটুই পােকার খুব উপদ্রব হয়। এসব পােকা দমনের জন্য একর প্রতি ১০-১৫ কে. জি, ফলিডল গুড়াে বা বি-এইচ-সি ১০ শতাংশ শেষ চাষের আগে প্রয়ােগ করতে হবে, বা গাছ লাগাবার পর নালিতে ওষুধ প্রয়ােগ করতে হবে। তবে মাটিতে ওষুধ দেওয়া কোনাে কারণে যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ৩০০ লিটার জলে ৪৫০ মি. লি. ক্লোরােফাইরিফস ২০ই-সি (যেমন পাইরিরান, ডার্সৰ্বান ইত্যাদি) গুলে বিচনের ওপর ছিটিয়ে দিতে হবে বা ওষুধ গােলা জলে বিচনগুলি ডুবিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে।

আখ চাষের উন্নত পদ্ধতি :-
----------------------------------------------
(১) আখ লাগানাের সময় আমাদের দেশে বছরে দুবার আখ লাগানাে হয়।
যথাক্রমে (ক) কার্তিক-অগ্রহায়ণে ;          (খ) ফান্তুন-চৈত্র মাসে।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে মাটিতে রস থাকায় এই সময় আখ চাষ করলে সেচ কম দিতে হয়, তাতে চাষের খরচও কম হয় এবং পাশকাঠি বেশি হয়, এর ফলে ফলনও ভালাে পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, আখ লাগাতে দেরী হলে পাশকাঠি কম হয়। গাছের বাড়-বাড়ন্তের জন্য দশ-বারাে মাসের বদলে ছয়-সাত মাস সময় পাওয়া যায়। ছিদ্রকারী পােকার আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই আখের অসুখ হতে দেখা যায়। এখানে চাষীভাইদের বলে রাখা ভালাে, আখ লাগানাের সময়ের ওপর ফলন অনেকটা নির্ভর করে।

(২) বীজ আখ বা বিচন বাছাই ও শােধন :
 
রােগমুক্ত বা বিচনের ওপর ফলন ভালাে হওয়া নির্ভর করে। এই কারণে বিচন বাছাইয়ের সময় কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে   এই যেমন :
(ক) বিচন যেন পুষ্ট ও রােগমুক্ত হয়। (খ) আখের ডগা বিচনের জন্য ব্যবহার করতে হবে। ডগার অংশে মিষ্টির পরিমাণ কম থাকে এবং অঙ্কুরগুলি কচি ও সক্রিয় থাকায় সহজেই অঙ্কুরিত হয়। (গ) বিচন খুব তেজী এবং পুষ্ট হওয়া দরকার। (ঘ) প্রতি টুকরাে বিচনে তিনটি চোখ থাকা আবশ্যক। (ঙ) বীজ আখের কাটা অংশে লাল দাগ দেখা দিলে তা বিচনের জন্য কখনােই যেন ব্যবহার করা না হয়। (চ) টুকরাে করে কাটবার সময় কাটা বিচনের অংশ যেন থেতলে না যায়।


৪০-৪৫ লিটার জলে (আড়াইটিন) ১০০ গ্রাম এমিসন-৬ বা ম্যানকোজের ৭৫ শতাংশ ডব্লিউ-বি (ডাইথেন-এম-৪৫) গুলে ১০০ কে. জি. বিচনের টুকরাে পাঁচ মিনিট ধরে ডুবিয়ে রাখার পর জল থেকে তুলে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে। এক এক জমিতে আখ লাগাতে যে পরিমাণ বিচনের প্রয়ােজন, তা শােধন করতে ৭৫০ থেকে ১০০০ গ্রাম ওষুধের প্রয়ােজন হবে। বিচনের ফোড় তথা কল করবার জন্য বিচনের টুকরােগুলাে এক সপ্তাহ হাপরে, মানে মাটির গর্তে রেখে তার ওপর খড় চাপা দিয়ে মাঝে মাঝে জল দিতে হবে।

(৩) বিচনের পরিমাণ :
 
প্রতি একরে ২০-২৫ কুইন্টাল, অর্থাৎ ৮০০০টি তিন চোখ ওয়ালা বিচনের প্রয়ােজন হবে, যা এত বেশি পরিমাণে একসঙ্গে পাওয়ার অসুবিধে হতে পারে। অবশ্য আজকাল একটি মাত্র চোখওলা বিচন লাগিয়ে যথেষ্ট সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

(৪) বিচন লাগানাের পদ্ধতি :
নিচে বর্ণিত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করে আখ লাগালে চাষীভাইদের আখের ভালাে হতে পারে।

(ক) সমতল জমির ওপর কি করে বিচন লাগবেন :
 
মই দিয়ে মাটি সমান করা জমিতে ৮০-১০০ সে. মি.-এর ব্যবধানে কোদাল দিয়ে অগভীর নালা তৈরী করতে হবে ।অগভীর নালায় একের পর এক বিচন বসিয়ে (দুটি বিচনের মাঝে কোনাে ফাঁক থাকবে না) তার ওপর দু-তিন ইঞ্চি (৫-৭.৫ সে. মি.) মাটি দিয়ে চাপা দিয়ে দিতে হবে।

(খ) নালার বিচন কী ভাবে লাগাতে হবে :
 
মােল্ডলবাের্ড বা ভেলি করা লাঙল দিয়ে অঞ্চল ভেদে ৪-৮ ইঞ্চি (১০-২০ সে. মি.) গভীর নালা কাটতে হবে। আখের টুকরাের চোখগুলাে পাশাপাশি একটার পর একটা নালাতে বসাতে হবে। মাঝে যেন কোনাে ফাক না থাকে। বেশির ভাগ সময় একটি বিচন অপরটিকে সামান্য জড়িয়ে লাগানাে হয়। বিচন যেন ৪-৫ সে. মি. মাটি দিয়ে চাপা থাকে। চারার বাড়বাড়ন্তের ওপর সমতা রেখে পরপর দু-তিনবার নালা ভর্তি করতে হবে।


(গ) গভীর নালায় কি ভাবে বিচন লাগাতে হবে :

ভেলি করা কোদাল দিয়ে ৪০-৪৫ ইঞ্চি (১০০-১১২.৫ সে. মি.) দূরে ৮-১০ ইঞ্চি (২০-২৫ সে. মি.) গভীর ও চওড়া করে নালা কাটতে হবে। নালার নিচের মাটি খুঁড়ে আক্সা করে দিতে হবে। অগভীর নালায় আগের পদ্ধতিতে বিচন লাগাতে হবে। তারপর নালায় জল ঢেলে পা দিয়ে বিচনগুলােকে ৫-৭ সে. মি. মাটি ঢেকে দিতে হবে। গাছের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সমতা রেখে নালি ভর্তি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই পদ্ধতির খরচ অনেক এই কারণে যে, সার বেশি লাগে, আর সেই সব সার প্রয়ােগ করার জন্য বেশি শ্রমিক লাগে। তাই স্বভাবতই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বাবদ খরচ অনেক বেড়ে যায়।

 আখ চাষে সারের প্রয়ােগ পদ্ধতি :
 
অন্য সব ফসলের তুলনায় আখ প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে এবং অনেকদিন ধরে জমিতে থাকায় সারের প্রয়ােগের প্রয়ােজন অনেক বেশি হয়। কৃষি আধিকারিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী একর প্রতি সারের পরিমাণ যা হবে তা এই রকম...

(১) প্রধান সার হিসাবে শেষ চারের আগে ২৫ কে. জি. নাইট্রোজেন, ২৫ কে. জি. ফসফরাস এবং ২৫ কে. জি. পটাশিয়াম প্রয়ােগ করতে হবে।
(২) এবার চাপান সারের প্রসঙ্গে আসা যাক, চাপান সার হিসাবে আখ লাগানাের ৫০-৬০ দিন পরে ২০ কে. জি. নাইট্রোজেন এবং ৯০-১০০ দিন পর ২০ কে. জি. নাইট্রোজেন প্রয়ােগ করতে হবে। এছাড়াও একর প্রতি ১১৫-১২০ কে, জি, সর্ষে খােল প্রয়ােগ করলে খুব ভালাে ফলন আশা করা যায়।


 সার প্রয়ােগের ব্যাপারে সুপারিশ হলাে এই রকম :


সেচ এলাকার জমিতে মোট খাদ্যোৎপাদনের পরিমান একর এ, নাইট্রোজেন ৬০ কেজি,ফসফরাস ও পটাশিয়াম ৩০ কেজি করে। মূল সার নাইট্রোজেন ২০ কেজি,ফসফরাস ও পটাশিয়াম ৪০ কেজি। চাপান সার একর এ, ৫০ ৬০ দিন পর নাইট্রোজেন ৩০ কেজি এবং ৯০ -১০০ দিন পর নাইট্রোজেন ৩০ কেজি।

সেচ-বিহীন এলাকার জমিতে মোট খাদ্যোৎপাদনের পরিমান একর এ, নাইট্রোজেন ৬০ কেজি,ফসফরাস ও পটাশিয়াম ৩০ কেজি করে। মূল সার নাইট্রোজেন ২০ কেজি,ফসফরাস ও পটাশিয়াম ৩০ কেজি। চাপান সার একর এ, ৫০ ৬০ দিন পর নাইট্রোজেন ২০ কেজি এবং ৯০ -১০০ দিন পর নাইট্রোজেন ২০ কেজি।

আখ চাষে জলসেচ পদ্ধতি :- 
আখ গাছ লাগাবার পর বৃষ্টি না হলে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু আখ গ্রীষ্মকালের ফসল, তাই মাটি ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে জলসেচে ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষার সময় সাধারণত জলসেচের প্রয়ােজন হয় না, তবে এই ঋতুতে জলনিকাশনের খুবই প্রয়ােজন হয়। শীতকালে দু-একবার সেচের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। আখ পরিণত হওয়ার এক মাস আগে থেকে জলসেচ বন্ধ করে দিতে হবে।

আখের সঙ্গে অন্য ফসল :
 
আখ পরিণত হতে প্রায় বছর খানেক সময় লেগে যায়, প্রথম তিন-চারমাস তাে খুব ধীরে ধীরে বাড়ে। অতএব এই সময় সারির মাঝখানের ফাকা জায়গায় স্বল্পকালীন ফসল চাষ করলে নামমাত্র খরচে বাড়তি আয় করা যায়। যেমন কার্তিক মাসে লাগানাে আখের সারির মাঝে সর্ষে, গম, আলু, শাক-সবজি এবং ফাল্গুন মাসে লাগানাে আখের সঙ্গে মুগ, তিল, তেঁড়স, পুই, বাদাম, সূর্যমুখী ইত্যাদি সহযােগী ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বেথুয়াডহরী আখ গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে চাষের যে ফলন পাওয়া যায়, একর প্রতি তার হিসাব নিচে দেওয়া হলাে :

(১) কেবল আখ = ৫৫ টন।
(২) আখ + গম = আখ ৫০ টন + গম ১৫ কুইন্টাল।
(৩) আখ + সর্ষে আখ ৪৫ টন + সর্ষে ১০ কুইন্টাল।

(৪) আখ + আলু = আখ ৫৫ টন + আলু ৭০ কুইন্টাল।

____________________________________________________________________________

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.