উন্নত পদ্ধতিতে গােলাপ ফুলের চাষ করুন। Rose flower cultivation:
ফুল চাষ বর্তমানে ব্যাপক চাহিদা প্রসার লাভ করেছে। যেখান থেকে মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। ফুল শুভেচ্ছা বার্তা বহন করে। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান ও বিবাহ এবং ঘর সাজানো ফুলের ব্যবহার বিস্তার লাভ করেছে। গোলাপ ফুল বিবাহ বাড়িতে এবং ভ্যালেনটাইন ডে প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই ফুল দ্বারা কোনো সম্মানীয়ব্যক্তিকে বরন করে নেওয়া হয়। এই ফুলের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। বর্ণবৈচিত্র্যে ,সুমধুর গন্ধে ও রমনীয়তায় অতুলনীয় গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয়।
![]() |
গোলাপ ফুল চাষে উপযোগী মাটি :
যথেষ্ট পরিমাণে জৈবপদার্থআছে, এমন দোঁয়াশ মাটি দরকার।জমিতে জল নিষ্কাশনের সুবন্দোবস্ত থাকা চাই। বর্ষাকালে পুকুরের জল যতদূর ওঠে, জমিকে হ’তে হবে তা থেকে অন্তত ১ হাত উঁচু। সামান্য অম্লধর্মী বা অম্লক্ষার- নিরপেক্ষে জমিতে গােলাপ চাষ ভাল হয়।
পরিবেশ : দিনে যেন ৬/৭ ঘন্টা রােদ গাছে লাগতে পারে এমন জমি চাই। আর দরকার প্রচুর খােলা হাওয়া। এর জন্য গােলাপ গাছের আশে-পাশে উঁচু কোনও গাছ লাগানাে উচিত নয়।
গোলাপ ফুলের চারা কীভাবে তৈরী করবেন তার পদ্ধতি :
বসন্তকালে চোখ কলমের দ্বারা গােলাপের চারা তৈরী করা যায়। এর জন্য চাই এলা। উন্নত গােলাপের চোখ অর্থাৎ কক্ষ মুকুল তুলে এলার (এলার বয়স ১-১২ বছর হলে ভাল) গায়ে বসাতে হয়। এলা অর্থাৎ বুনো সহনশীল জাতের গােলাপ গাছ যার প্রতিটি ডালে থাকে ৭টি করে পাতা। এতে ফুল হয় না। এলার ছােট চারা মেলে নার্সারিতে। অথবা এলা টুকরাে করে কেটে টবে/মাটিতে বসিয়ে সেচ দিয়ে চারা তৈরী করতে হয়। এর জন্য চৌকো, রােদযুক্ত পটে খােল, গােবর সার, হাড় ও শিং-এর গুঁড়ে দিয়ে মাটি বানান। ১৫ দিন এভাবে রাখার পর ৪ ইঞ্চি অন্তর এলা বসান।
এলা চারা থেকে বের হওয়া ডালের ৩/৪টে পাতা রেখে ছেটে দিন। এবার উন্নত গােলাপের গা থেকে বড় পাতার ডাঁটি সমেত খুলে দিয়ে চোখটা ব্লেড দিয়ে এমনভাবে তুলুন যাতে সেটা ছাল সমেত ঠিক ১/২ ইঞ্চির মতাে লম্বা হয়। (চোখের সাথে পাতা যেন না থাকে) কেটে নেওয়া এই চোখের ছালের নীচের কাঠ অংশটাকে ব্লেড দিয়ে তুলে ফেলে দিন। এবার এলার মাটি সংলগ্ন জায়গায় ১টা গাঁট ছেড়ে কাণ্ডের ছালটা'T'-এর মতাে করে চিরে ব্লেড দিয়ে ছালটা T-এর মতাে করে চিরে ব্লেড দিয়ে ছালটা T'-এর ওপর দিক থেকে একটু আলগা করে দিন। এবার চোখ সমেত ঐ ১/২ ইঞ্চি ছালটুকু ঢুকিয়ে দিন ঐ 'T'-এর ওপর থেকে নীচের দিকে ঠেলে; চোখটাকে ঐ ছালের নীচে চাপা পড়বে না।
শুধু ছালটুকু ছালের তলায় চাপা এই অবস্থা পাতলা প্লাসটিকের টেপ আর সূতাে দিয়ে চেপে বাঁধুন। বারংবার জল দিয়ে জায়গাটা ভেজান। ১৪-২০ দিনেই মুকুল বাড়তে থাকবে।মুকুল বেড়ে উন্নত গােলাপের শাখা বাড়তে থাকবে। তখন ঐ নতুন গজানাে ডালের ওপর থেকে এলা ছেঁটে নিন। কিছুদিন পরেই ফুল আসবে গােলাপের ডালে।
এক্ষেত্রে কয়েকটা কথা মাথায় রাখতে হবে - মুকুল শুকনাে বসাবেন না। চোখ তুলে পাত্রে জল দিয়ে তাতে রাখুন। চোখটা বসানাের পর চোখ বসানাের জায়গাটা জল দিয়ে ধুয়ে দেবেন। রেড মাইটসের উৎপাত থেকে বাঁচতে ১০ টার জলে ১০ মিলি লিটার ডাইকোফল জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে স্প্রে করুন।
আবহাওয়া : বেশির ভাগ গােলাপের প্রজাতিগুলি শীতপ্রধান থেকে নাতিশীতােষ্ণমণ্ডলীয় আবহাওয়া ভালাে বৃদ্ধি পায়। গােলাপের ক্ষেত্রে ১৬-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা, ৮৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং ১০০-১২৫ সেমি বৃষ্টিপাত আদর্শ।
গোলাপ ফুলের জাত:
আধুনিক গােলাপের প্রকারগুলি ও প্রাচীন প্রকারগুলির মধ্যে বারংবার সংকরায়ণের ফলে বর্তমান জাতগুলি উদ্ভূত হয়েছে। এগুলি হল—সংকর বা হাইব্রিড-টি এবং ফ্লোরিবানডস। এই প্রকারগুলির অন্তর্গত ফুলের রং বিভিন্ন হয়, নীচে দুই প্রকারেরই কিছু জাতের উদাহরণ দেওয়া হল।
হাইব্রিড-টি: প্রাইমার বল, ভিক্টোরিয়া, বারবারা, ভ্যালেন্সিয়া, রেডিফেস, অ্যামেরিকান বিউটি, ফার্স্ট লাভ, স্নাে-গার্ল, ইডেন রােজ, ডায়মণ্ড, লাকি চার্ম, পার্থেনন ইত্যাদি।
ফ্লোরিনডস : সামার স্নাে, গােল্ডেন জুয়েল, আইসবার্গ, প্রভৃতি।
বংশবিস্তার :
গােলাপের উন্নত জাতগুলির বংশবিস্তারের জন্য কলি-কলম, জোড়-কলম, দাবা-কলম, কাণ্ডের ছেদন প্রভৃতি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বর্তমানে কলি-কলম যেমন, টি-বাডিং (T-budding) পদ্ধতি বিশেষ প্রচলিত আছে।
গোলাপ ফুল চাষে জমি কীভাবে তৈরি করবেন তার পদ্ধতি :
চারা রােপণের ২-৩ সপ্তাহ আগে জমিতে সােজাসুজি ও আড়াআড়ি কর্ষণ এবং তারপরে মই দেওয়ার মাধ্যমে মাটি বেশ গভীর ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। কর্ষণের সময় প্রতি ১০০০ বর্গমিটার জমির জন্য ১.৫-২.০ টন পচানাে খামারের সার বা কম্পােস্ট প্রয়ােগ করতে হবে।এছাড়া বেশি অম্লতাযুক্ত মাটির অম্লতা নাশের জন্য চুন বা কাঠের ছাই (প্রতি বর্গমিটারে ১.০০-১.৫০ কেজি হিসাবে) প্রয়ােগ করা উচিত। তারপর জমি সমতল করে ৬ মিটার x ১.২ মিটার মাপের ছােটো ছােটো প্লট তৈরি করতে হবে। দু’ সারি প্লটের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা, জলসেচ ও জলনিকাশি নালি তৈরি করে রাখতে হবে।
গোলাপ ফুলের চারা কখন কীভাবে রােপন করবেন তার পদ্ধতি :
অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে গােলাপের কলম বসানােই ভাল। হাইব্রিড টি শ্রেণীর জাতির ক্ষেত্রে ৬০ সেমি প্রতি সারি ও ৩০ সেমি প্রতি গাছ ব্যবধান রেখে চারা বসাবেন।
চারাগুলি এক বছর নার্সারিতে লালন-পালনের পরে মূল জমিতে রােপণের উপযােগী হয়। সাধারণতঃ সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাস চারা লাগানাে পক্ষে উপযুক্ত। চারাগুলির মধ্যে নিম্নলিখিত দূরত্ব বজায় রাখা হয়।
প্রকার - খর্বাকৃতি, সারি থেকে সারি ৪৫ সেমি। গাছ থেকে গাছ ৪৫ সেমি.
হাইব্রিড-টি, সারি থেকে সারি ৭৫ সেমি। গাছ থেকে গাছ ৭৫ সেমি।
ফ্লোরিডা ও অন্যান্য উন্নত জাত, সারি থেকে সারি ১ মিটার।গাছ থেকে গাছ ১ মিটার।
চারা রােপণের স্থানগুলিতে ৪৫ সেমি x ৪৫ সেমি x ৪৫সেমি মাপের গর্ত খুঁড়ে প্রতি গর্তে ২৫০ গ্রাম হাড় গুড়াে বা সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ২০০ গ্রাম নিম বা রেড়ির খােল এবং মাটি একসঙ্গে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। তারপর হালকা ভাবে সেচ দিয়ে এক সপ্তাহ পরে গর্তের ঠিক মাঝখানে চারাটিকে সােজাভাবে বসিয়ে দিতে হবে এবং গাছের গােড়ায় একটু মাটি ধরিয়ে দিয়ে চারধার একটু চেপে দিতে হবে। গাছের কলি-বসানাে জোড়া স্থানটি অবশ্যই মাটির উপরে রাখতে হবে। চারা রােপণের পর প্রতি গাছে কয়েকদিন ধরে হালকা সেচ দিতে হবে। উইয়ের উপদ্রব এড়ানাের জন্য নিম বা রেড়ির খােল প্রয়ােগ করা দরকার।
সার প্রয়ােগ পদ্ধতি:
গাছের বৃদ্ধিকালে প্রতি মাসে একবার করে সুষম সার হিসাবে তরল সার প্রয়ােগ করতে হবে। তরল সারের জন্য প্রয়ােজনীয় বস্তুগুলি হল- ওজন হিসাবে অ্যামােনিয়াম সালফেট-৩ ভাগ, পটাশিয়াম সালফেট-২ ভাগ, সিঙ্গল সুপার ফসফেট-১৬ ভাগ, ফেরাস সালফেট-০.৫ ভাগ।এর সঙ্গে ৭০০ গ্রাম গােবর সার ও ৩০০ গ্রাম নিম বা রেড়ির খােল ৫ লিটার জলে মিশিয়ে (জৈব সার জলে এক সপ্তাহ আগে ভিজিয়ে রাখতে হবে) নিতে হবে। এছাড়া ৫ গ্রাম ফোরেট-১০জি বা ১০ গ্রাম একালাক্স ৫জি মেশানাে যেতে পারে। এই মিশ্রণের সঙ্গে এর তিনগুণ বেশি পরিমাণ জল মিশিয়ে প্রতি গাছের গােড়ায় এক লিটার করে (প্রায় এক মগ) প্রতি মাসে একবার করে প্রয়ােগ করতে হবে।
জলসেচ :
চারা রােপণের পর প্রথম বছর শীত ও গ্রীষ্মকালে নিয়মিত হালকা সেচ দিতে হবে। শীতকালে গাছের মূলাঞ্চল (১০-১২ সেমি গভীর পর্যন্ত) ১০-১২ দিন ছাড়া ও গ্রীষ্মকালে ৫-৬ দিন ছাড়া বেসিন পদ্ধতিতে জলসেচ দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা :
নিয়মিত বাগানের আগাছা দমন এবং ২-৩ বার সেচ দেওয়ার পর একবার করে গাছের গােড়ার মাটি আলগা করে দেওয়া প্রয়ােজন। প্রতি মাসে জমিতে একবার হাল্কাভাবে পচানাে খামারের সার বা কম্পােস্ট ছড়িয়ে দিয়ে হাল্কা চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালােভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বর্ষার শুরুতে প্রতি গাছের গােড়ার মাটি সরিয়ে দিয়ে ১০০-২০০ গ্রাম হিসাবে জৈব সার মিশিয়ে গাছের গােড়ায় মাটি ধরিয়ে দিতে হবে।
শীতে ভালাে ফুল পাওয়ার জন্য অক্টোবর মাসের প্রথম থেকে সেচ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর প্রতি গাছের গােড়ার চারদিকের মাটি ১০-১৫ সেমি গভীর ভাবে খনন করে উপরের স্তরের কিছু মূল মাটি থেকে আলগা করে দিতে হবে। এই পদ্ধতিকে শৈত্যকরণ বলা হয়।
এর কয়েক দিনের মধ্যেই (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর) ভারী ছাঁটাই (heavy pruning) করতে হবে।বছরের অন্যান্য সময়ে হালকা ছাঁটাইয়ের প্রয়ােজন হয়। ছাঁটাই করার পরে ছেদন স্থানে ব্লাইটক্স-৫০ বা ব্যাভিস্টিন-৫০ গুড়াে ভেসলিনের সঙ্গে (১:৫ অনুপাতে) মিশিয়ে ওই মিশ্রণের প্রলেপ দিতে হবে।
এরপর প্রতি গাছে ২ কেজি খামারের জৈব সারের সঙ্গে সুফলা (১৫-১৫-১৫) মিশিয়ে গাছের গােড়ায় প্রয়ােগ করে জলসেচ দিতে হবে। তারপর ৬০ দিনের মধ্যে আর একবার সুফলা প্রয়ােগ করা দরকার। ফসল রক্ষার জন্য মাসে একবার নুভাক্রম ৩৫ ইসি ও ব্যাভিস্টিন-৫০ এর ০.১ শতাংশ মিশ্রণ সমান ভাবে স্প্রে করতে হবে।
ফসল তােলা ও ফলন :
উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে কলমের চারা লাগানাের ৫-৬ মাস পর থেকেই গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে এবং ৫-৬ বছর পর্যন্ত ভালাে ফুল পাওয়া যায়। বেশ ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় যেমন— ভােরবেলা বা সন্ধ্যের একটু আগে গাছ থেকে ফুল তােলা হয়। ফুলের বোঁটাসহ শাখার কিছু অংশ (প্রায় ৩০-৪০ সেমি লম্বা) কেটে নিলে সংরক্ষণের সুবিধা হয়। ফুল কাটার সঙ্গে সঙ্গে জল ভর্তি বালতিতে গােড়ার দিক খাড়াভাবে খানিকক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর প্রয়ােজন মত ৬টি, ১৩টি অথবা ১০০টি হিসাবে আঁটিতে বেঁধে বাজারে পাঠানাে হয়।জাত অনুসারে শীত এবং বসন্ত ঋতুতে হেক্টর- পিছু প্রতিদিন ২৫০০০- ৩০০০টি কাটা ফুল পাওয়া যায়।
আমাদের এই website-এ প্রবেশ করার জন্য আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধ্যন্যবাদ।আমরা এই ওয়েবসাইট -এর মাধ্যমে সমস্ত শাক-সবজি,বিভিন্ন ফসল ও ফুল গাছের চাষ অর্থাৎ চাষবাস এর সবরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পোস্ট করে থাকি। আমাদের এই পোষ্টটি ভালোলাগলে আমাদের ওয়েবসাইট (চাষবাস-বারোমাস)-টিকে Follow করতে পারেন।পারলে আপনারা LIKE ও SHARE করবেন। আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাতে পারেন আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ধ্যন্যবাদ।
___________________________________________________________________________
If you have any doubts or questions, please let me know.... যদি আপনার কোনও সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকে তবে দয়া করে আমাকে জানান.....