Type Here to Get Search Results !

উন্নত পদ্ধতিতে গম চাষ সন্মন্ধে জানুন। Wheat Farming.

গম চাষ। Wheat Farming :
 
আমাদের দেশে খাদ্যশস্যের ব্যবহার হিসাবে ধানের পরেই গমের স্থান। গম ধানের তথা চালের মতোই একটি প্রধান খাদ্য-শস্য। ভারতে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে গমের চাষ হয়।ষাট দশকে ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান ও গবেষণাকেন্দ্র মেক্সিকো থেকে কয়েকটি বেঁটে উচ্চফলন শীল  জাতের গমের বীজ আমদানী করার পর থেকে ভারতে গমের চাষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সবুজ বিপ্লব ঘটে গেছে।


উন্নত পদ্ধতিতে গম চাষ  সন্মন্ধে জানুন।  Wheat Farming.
Image by Pezibear from Pixabay 

ভারতের প্রায় ৩ কোটি ৪২ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মেট্রিক টন গম উৎপন্ন হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে গম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৮.২৫ লক্ষ টন। গম উৎপাদনে ভারত বর্তমানে পৃথিবীর চতুর্থ স্থান অধিকার করে রয়েছে। ভারতে গম উত্তরপ্রদেশ প্রথম, পাঞ্জাব দ্বিতীয়, মহারাষ্ট্র তৃতীয় এবং হরিয়ানার স্থান চতুর্থ। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, গম উৎপাদন হয়। বাকি জেলাগুলিতেও কিছু গমের চাষ হয়।  খাদ্য হিসেবে গম খুবই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর। এতে শতকরা ৭৫ ভাগ শর্করা জাতীয় উৎপাদন (কার্বোহাইড্রেড) ১২.৫ ভাগ আমিষ জাতীয় উপাদান (প্রােটিন), ১.৮ চর্বি (ফ্যাট), ১.৯ ভাগ খনিজ পদার্থ ও যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যগ্রহণ (ভিটামিন) ‘বি’ কমপ্লেক্স পাওয়া যায়। গমে অন্যান্য দানাশস্যের চেয়ে বেশি প্রােটিন থাকে।

➤ গমচাষ সন্মন্ধে জানুন। 
গম চাষ জানতে হলে  আগে তার জলবায়ু, মাটি ও গমের বিভিন্ন জাত সম্পর্কে জানা খুবই প্রয়োজন। 

জলবায়ু :- 

গম সাধারণত শীতঋতুর ফসল। এই কারণে গরম ও ভিজে অঞ্চলে গম চাষ হয় না।যেসব জায়গায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫-৪০ ইঞ্চি (৩৭.৫-১০০ সে. মি.) এবং তাপমাত্রা ৬০° ফারেনহাইট (১৫.৫° সেলসিয়াস), কেবলমাত্র সেইসব অঞ্চলই গম চাষের পক্ষে উপযুক্ত। অবশ্য যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৫-৩০ ইঞ্চি (৬২.৫-৭৫.০ সেমি.) সেখানেই গমের উৎপাদন সবচেয়ে ভাল হয়। কিন্তু ৩০ ইঞ্চির (৭৫.০ সেমি.) কম বৃষ্টিপাত হলে সেচ দিয়ে এবং শুকনাে চাষ প্রণালীর দ্বারা গম চাষ করা যায়। গমের প্রধান শত্রু হলাে ঝড়-বৃষ্টি, গমের ফুল আসার সময় তুষারপাত এবং দানা তৈরীর সময় ঝড়বৃষ্টি হলে ফসলের দারুণ ক্ষতি হয়।
 
গম চাষে উপযুক্ত মাটি :- 

দোঁয়াশ, বেলে-দোঁয়াশ , পলি-দোঁয়াশ  এবং এটেল-দোঁয়াশ মাটিতে গম চাষ
করার পক্ষে খুবই উপযুক্ত। জলসেচ এবং জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা দরকার। জমিতে (আর্দ্রতা) থাকতে থাকতে ৫-৬ বার চাষ ও চাষ দেওয়ার পর মই দিয়ে জমি তৈরী করতে হবে। জমি তৈরীর সময় একর প্রতি ৮-১০ গাড়ি গােবর সার প্রয়ােগ করতে হবে। উই, কাটুই পােকা বা ঘুরঘুরে পােকার উপদ্রব থাকলে প্রতি একরে ১০-১২ কেজি, ভার্সৰ্বান ১০ শতাংশ গুঁড়াে ওষুধ শেষ চাষের আগে প্রয়ােগ করতে হবে। সেচ তাে করবেন, কিন্তু সে জল জমির সর্বত্র সমান ভাবে বন্টন হলাে কিনা তা অবশ্যই দেখতে হবে, আর যদি দেখেন অসমান, তাহলে সেজন্যে মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। জলসেচ ও জল নিকাশের মধ্যে ১৫-২০ হাত ব্যবধান তৈরী করে নেওয়া প্রয়ােজন। জমিতে রসের অভাব ঘটলে বীজ বপন করার চার-পাঁচ দিন আগে সেচ দিয়ে তবেই গমের বীজ বুনতে হবে।
আমনের জমি, তথা এঁটেল-দোআঁশ হলে তাতে আদ্রতা আসতে বিলম্ব হয় এবং এর ফলে গম বুনতে দেরী হয়। অতএব এরকম জমির মাটি তৈরী না করেই বপন করা কি অসম্ভব? না, কোনাে কিছুই অসম্ভব নয়! জমিতে লাঙল দিয়ে ধান গাছের দুটো সারির মাঝে নালি কেটে সেই নালিতে গমের বীজ বুনে দেওয়া যায়। এতে ফলনের তেমন কোনাে তফাত দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, এর জন্য জমি তৈরীর কোনাে খরচ লাগে না।
 
 গমের জাত  :- 
লম্বা জাতের গম ও পশ্চিমবঙ্গে চাষের উপযােগী নানান লম্বা জাতের গম হলাে যথাক্রমে -
এন-পি (নিউপুসা) ৭১০, এন-পি-৫২, এন-পি-৭৭০, এন-পি-৭৯৮, এন-পি-৮০৯, বিড়াল ইত্যাদি। এই জাতগুলি ভারতীয় কৃষি-গবেষণা কেন্দ্র (পুসা) সৃষ্টি করেছিল। আর এন-পি-৮০৯ ও বিড়লে পাহাড়ী এলাকায় চাষ করার পক্ষে উপযুক্ত।

উচ্চ ফলনশীল বেঁটে জাতের মেক্সিকান গম :- 
আমেরিকার উচ্চফলনশীল বেটে জাতের।বােরলগ-এর সৃষ্ট এই উচ্চ ফলনশীল বেঁটে জাতের গম আবিষ্কারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সবুজ বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ষাট দশকে কয়েকটি বেঁটে জাতের মেক্সিকান গম, যথাক্রমে লারমা রােজো, সরবতি সােনারদ, সােনরা-৬৩, সােনারা-৬৪ ইত্যাদি, ভারতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানে এনে সেখানে এবং কয়েকটি রাজ্যের গম গবেষণা কেন্দ্রে এই জাতগুলাের গম চাষ করা  হয় ।এই সব জাতের গম চাষ করে দেখা গেলাে, উপযুক্ত পরিমাণে সার প্রয়ােগ এবং যত্ন পরিচর্যা করলে দেশী উন্নত জাতের গমের তুলনায় অতি সহজেই দুতিন গুণ বেশি ফসল তােলা যায়। ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রে কৃষি বিজ্ঞানীরা মেক্সিকান জাতের বেঁটে গমের সঙ্গে দেশী ও বিদেশী জাতের গমের সংমিশ্রণে আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ুর উপযােগী উচ্চ ফলনশীল গমের আবিষ্কার করেছেন। ভারতের কৃষি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এই জাতগুলি মেক্সিকান জাতের গমের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। এই জাতগুলির কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকার দরুন ফলন অনেক বেশি হয়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ----

(১) এই সব জাতের গাছগুলাে বেঁটে হয়।
(২) প্রচুর সার ও উপযুক্ত সেচ দেওয়ার পরেও গাছগুলি শুয়ে পড়ে না।

(৩) জাতগুলি অনেকটা তাপ অনুভূতিবিহীন, যার অর্থ হলাে কম ঠাণ্ডাতেও ফসল ভালাে হয়।
(৪) এ জাতের গম গাছে একই সময়ে বেশি পাশকাঠি বের হয়, সব পাশকাটিগুলিতেই এক সঙ্গে ফুল আসে এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যাও বেশি হয়।
(৫) এই জাতগুলির রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা আছে।
(৬) এই জাতগুলি বিভিন্ন ধরনের মাটি ও আবহাওয়ার উপযােগী এবং পাকেও খুব তাড়াতাড়ি।

ইতিমধ্যেই গমের বহু জাত বেরিয়ে গেছে এবং আরও নতুন নতুন ফলনশীল জাত বের হচ্ছে, ভবিষ্যতেও আরও হবে। আপাতত যে সব জাতের গম বেরিয়ে গেছে, সেগুলি হলাে - সােনালিকা, কল্যাণসােনা, ছােটি লারমা, সরবতি সােনারা, সােনারা-৬৪, সফেদ লারমা, লারমা রােজো, হীরা, মােতি,পুসালারমা, জনক, গােরা, ডব্লিউ-জি-৩০৭, ইউ-পি-৩৩১, ইউ-জি-৩১০, ইউ-পি-১১৫, ইউ-পি- ২৬২, মালব্য-৫৫, এইচ-ডি-১৯৪৪, এইচ-ডি-১৯৫০, গঙ্গা (এইচ-ডি-২৬৪৩), এইচ-পি-৯৫৩, রাজলক্ষী (এইচ-পি-১৭৩১), এইচ-পি-১১০২, এইচ-পি-১২০৯, এইচ-পি-ডি-২২৮৫, এইচ-ডি-২৪৪১, এইচ-ডি-২৮৮৫, কে-৮৮০৪,কে-৯০০৬, রাজ-৩০৭৭, ডি-এল-৭৮৪৩ এইট-ইউ ডব্লিউ-১৩৮,২৩৪, ৪১১ ও ৪৬৮, পূর্বালী (বি-ডব্লিউ-১১), রাজেশ্বরী (এইচ-পি-১৭৪৪), সােনালী, এইচ-পি-১৬৩৩, তিস্তা (বি-ডব্লিউ-১০০৮), প্রতাপ, কানন—২২৭, এস ডব্লিউ-৩৬, এস-এন-এইচ-৯, কে-আর-এল-১৩, এইচ-পি-১৫২৯, কে-আর-এল ২-২২, জবর-২৩২৮, পি-বি- ডব্লিউ-৪৪৩, এইচ-ইউ-ডব্লিউ ৪৬৮, এ-ডব্লিউ-১০১৪ ও ১০১২, দেবা (কে-৯১০৭), গিরীজা, বিড়লে ইত্যাদি জাত চাষের অনুমােদন লাভ করেছে।

 লবণাক্ত জমিতে চাষের উপযােগী জাত :- 

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে সমুদ্রপােকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাটি লবণাক্ত। এখানে শীতের স্থায়িত্বও খুবই কম। লবণ সহ্য করতে পারে এরকম উপযুক্ত জাত না থাকা সত্ত্বেও হাতের কাছে যে বীজ পাওয়া যায়, তা দিয়েই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গম চাষ করা যায়। মিষ্টি জলের অভাব থাকা সত্ত্বেও অনেক চাষীভাই বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে বােরাে ধানের চাষ করে থাকে এবং মােটামুটি সাফল্যও পেয়ে থাকে।

তাই এখানে মিষ্টি জলের অভাব থাকায় এবং ধানের তুলনায় গমের ক্ষেত্রে এক পঞ্চমাংশ কম জল প্রয়ােজন হওয়ায় উপযুক্ত জাত ও তার পরিচর্যা উদ্ভাবন করতে পারলে এ অঞ্চলেও গম চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সেই অনুযায়ী নিচে বর্ণিত জাতগুলি যথেষ্ট সম্ভাবনার দাবী রাখে। যেমন : এস-ডব্লু -৩৬, এস-এন-এল -৯, কে-আরএল-১৩, জাতনার -৬৬৬,  এইচ-পি-১৫২৯, কে -আর -এল -২-২২, জাবনার -২০২৮, ইত্যাদি।
“নােরিন জিন” সম্বলিত এসব জাতগুলি মধ্যে নিচে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলি সারা বিশ্বে সবুজ বিপ্লবের দিশারী হিসাবে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে :-

(১) উচ্চতায় ছােট, অর্থাৎ বেঁটে বলা যায় (৭০-১০০ সেমি.)।
 (2) কাঠি শক্ত, আর এই কারণেই অফিস উর্বরতা দরুণ বা সামান্য ঝড়ে তা ঢলে পড়ে না।

(৩) শীষসহ বিয়ানের সংখ্যা বেশি এবং শীষ প্রায় একই সঙ্গে থাকে।
(৪) শীষে দানার সংখ্যা বেশি হয়।

(৫) এই চাষের সময় স্বল্পমেয়াদী হয় অর্থাৎ ১০০ থেকে ১১৪ দিনে পাকে।
(৬) পরিবেশ ভেদে অদ্ভুতভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে।

(৭) এর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলাে এই যে, অধিক পরিমাণ রাসায়নিক সার প্রয়ােগ করতে হলেও অধিক ফলন ফলানাের ক্ষমতা আছে।
 
__________________________________________________

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.